প্রকাশিত: ১৭/০৮/২০১৭ ৯:৩৭ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ২:৫৮ পিএম

কখন কিভাবে জনবসতি এসে বসবাস শুরু করেছিল এই দ্বীপে তার সঠিক প্রমাণ দিতে পারলেও অন্তত ২৫০ বছর পূর্বে থেকেই এখানে জনবসতি শুরু হয়েছিল এমনটাই দাবি করেন এখানকার প্রায়ই মুরব্বীগণ। এই দ্বীপের কেন্দ্রীয় বড় মসজিদ ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, বাপ – দাদারা অন্যত্র থেকে নারকেল গাছের চারা এনে রোপণ করেছিলেন দ্বীপের সর্বত্র তাই তারা এই দ্বীপের নাম রাখেন নারকেল জিঞ্জিরা। অবশ্য নারকেলের সাথে জিঞ্জিরা সংযুক্তির পেছনে বেশ কারণও রয়েছে। তখন নাকি তারা (মুরব্বীগণ) দ্বীপের প্রায়ই জায়গায় জ্বীনপরীদের চলাফেরার লক্ষ্য অনুভব করত। তাই নারকেলের সাথে জিঞ্জিরা সংযুক্তি। সবুজ – শ্যামল গাছে গাছে সমারোহ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল এই দ্বীপ। দ্বীপের সর্বত্র পাওয়া যেত প্রবাল, শৈবাল, ঝিনুক, কড়ি, শেওলা, চুনাপাথর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। সাগরের খুব কাছেই পাওয়া যেত বড় বড় সব সামুদ্রিক মাছ। চাল, মরিচ, পেঁয়াজ, আলু, রসুন, টমেটো, শসা, তরমুজ প্রায়ই সব তরিতরকারি উৎপাদিত হত এই দ্বীপে। খুব স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত হত এখানকার মানুষের। কিন্তু সেই আনন্দময়ী জীবন বেশিদিন ঠিকেনি এই দ্বীপের মানুষের ভাগ্যে। ভাগ্যদেবী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাদের উপর থেকে। ঘূর্ণিঝড়, প্রবল বর্ষণ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অযোগ্যতা, খামখেয়ালি ও চরম স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আজ পুরো দ্বীপ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। যারা নিজেদের উপর গচ্ছিত সম্পদ রক্ষা করতে জানেননা ভাগ্যদেবী – বা কেন তাদের উপর আস্থা রাখবে!!

১৯৯০ সালের দিকে প্রথম পর্যটক আসা শুরু হয় এই দ্বীপে। শুরু হয় আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে যায় দ্বীপের নাম। নারকেল জিঞ্জিরা থেকে হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ। ৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে করে এই দ্বীপে প্রথম পা রাখেন বাংলার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ড. হুমায়ুন আহমদ। তিনি তার যাদুময় চোখে এই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলেন। তাই সম্ভবত ফিরে যাওয়ার সময় একখানি জমি কেনার মনোনিবেশ পোষণ করেছিলেন। যেই কথার সেই কাজ তিনি (হুমায়ুন আহমদ) চলে যাওয়ার কিছুদিন পর দ্বীপের পশ্চিমা বীচে একখানা সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘ক্রয়-সুত্রে এই জমির মালিক ড. হুমায়ুন আহমদ’। সেখানে তিনি একটি মিউজিয়াম তৈরি করেন যা বর্তমানে সমুদ্র বিলাস রিসোর্ট নামে পরিচিত। হুমায়ুন আহমদ এই দ্বীপ নিয়ে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নামে একটি উপন্যাসও রচনা করেন যা পরবর্তীতে দারুচিনি দ্বীপ টেলিফিল্ম হিসেবে প্রকাশিত হয়। ওনার এই লিখনির পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগে এবং ধীরে ধীরে এই দ্বীপে পর্যটক বাড়তে থাকে। বর্তমানে বছরে প্রায় কয়েক লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে এই দ্বীপে। বিনিয়োগকারীদের মাঝেও ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। অসংখ্য দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারী জমি কিনে হোটেল – রিসোর্ট করে যাচ্ছে। জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় দ্বীপবাসীর মাঝেও জমি বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। জমি কেনাবেচায় তিন শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এক শ্রেণী যারা জমি কিনে, ২য় শ্রেণী যারা জমি বিক্রি করে, ৩য় শ্রেণী যারা মিডিয়া অর্থাৎ দালাল! জমির মালিক জমি বিক্রি করে কিন্তু টাকা যায় দালালের হাতে। জমির প্রকৃত মুল্যের ২৫% পাই জমির মালিক, ওয়ারিশ সনদের দোহাইয়ে ২৫% পাই মহামান্য জনপ্রতিনিধি, জমির মালিককে জমির সম্পূর্ণ অর্থ না দিয়ে জোরপূর্বক জমি দখলের মাশুল হিসেবে ৫% পাই দালালের লালিত – পালিত মস্তানেরা যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী। বাদবাকি ৪৫% চলে যায় দালালের পকেটে। অন্যদিকে জমি ক্রেতা উচ্চ দামে জমি কেনার পর নির্দিষ্ট সময়ে জমি বুঝে পাইনা। এভাবেই দালালদের কাছে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন জমি ক্রেতা ও বিক্রেতারা। ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরাশ হয়ে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।

আধুনিক বাংলাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে পর্যটকদের সুবিধার্থে এই দ্বীপে গড়ে তোলা হয়েছে উন্নতমানের হোটেল – রিসোর্ট, জেটি, ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, আধুনিক আবহাওয়া অধিদপ্তর, কোস্টগার্ড স্টেশন, নৌবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট, পুলিশ ফাঁড়ী, সরকারি ডাকবাংলো, মডেল ইউনিয়ন পরিষদ, উচ্চ বিদ্যালয়সহ অনেককিছু।
পর্যটকদের সুবিধার্থে শত শত হোটেল – রিসোর্ট তৈরি হলেও নেই কোন বিদ্যুৎ সুবিধা। ফলে পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে সব হোটেল – রিসোর্টে চলে নিজস্ব জেনারেটর। প্রায়ই সব হোটেল রিসোর্ট দ্বীপের একাংশে হওয়ায় শত শত অত্যাধুনিক জেনারেটরের শব্দে প্রতিনিয়ত কম্পিত হচ্ছে এই দ্বীপ। চরম শব্দ দুষণের স্বীকার হচ্ছেন এই দ্বীপের মানুষ। পরিবেশবাদীদের মতে এটি একটি পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা। সংকটাপন্ন এলাকা হলেও হোটেল মালিকেরা অর্থের বিনিময়ে অনায়াসে বহুতল ভবনাদি নির্মাণ করতে পারে কিন্তু এলাকার মানুষগুলো মাথা গুঁজানোর জন্য সামান্য টিন, বাঁশ, কাঠ এমনকি যাতায়াতের ট্রলার নির্ভর এই দ্বীপে মেশিনারি জিনিস আনতেও দুনিয়ার জামেলা পোহাতে হয়। ইউপি চেয়ারম্যান, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও ইউএনও’র অনুমতি লাগে এই দ্বীপে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আনতে। আর অনুমতি পেতে দিতে হয় মানসম্মত মাসোয়ারা। বিজিবি ও ইউএনও অফিস চেয়ারম্যানের অনুমতিকে কোন গ্রাহ্যই করেনা। তাদের (বিজিবি ও ইউএনও অফিস) অনুমতি লাগবেই আর তাদের অনুমতি মানসম্মত সালামি ছাড়া পাওয়া যায়না। যে দ্বীপে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আনতে এত বাঁধা – বিপত্তি সে দ্বীপে প্রকাশ্য দিবালোকে কিভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায়! যাদেরকে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করি তাদের কোন কথা যদি প্রশাসন না শুনে তাহলে কেনইবা তাদের জনপ্রতিনিধি বানাব! শুধু এলাকার মানুষকে শোষণ করার জন্যই কি তারা প্রতিনিধি! এলাকার মানুষ জমি বিক্রি করলে সেখান থেকে মাসোয়ারা খাওয়ার জন্যই কি তারা প্রতিনিধি! হোটেল মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে হোটেল তৈরি করে দেওয়ার জন্যই কি তারা প্রতিনিধি!

বর্তমানে এই দ্বীপে প্রায় জমিজমা বাইরের লোকদের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় তেমন কোন ফসলী জমিও নেই। ফলে প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস টেকনাফ থেকে আমদানি করে চলতে হয় এই দ্বীপের মানুষের। টেকনাফের কথিত ইজাদারেরা কোন ধরণের নিয়মনীতি অনুসরণ না করে ইচ্ছামত হাছিল আদায় করে। কেউ কোন ধরণের প্রতিবাদ করলে মারধরের ঘটনাও ঘটে। ফলে দ্বীপাঞ্চলের মানুষ বলে ভয়ে মুখ খুলেনা কেউ ইজাদাররা যা চাই তা দিয়ে যাই। এভাবেই দিনের পর দিন চরম অবহেলার শিকার হচ্ছেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষ। অথচ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এসব কিছুই চোখে পড়েনা।

যারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ভিটামাটি বিক্রি করেছিল আজ তাদের কপালে দুঃখের বাসা বেঁধেছে। একসময় যারা নিজেদের জমিতে ফসল বুনে আর সাগরের খুব কাছে পাওয়া মাছ নিয়ে সুন্দর জীবন খাটাতো আজ সেগুলো তাদের মাঝে কেবল স্মৃতি। ফসল ফলানোর জায়গাজমিতো নেই সাগরের মাছও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যেসব মাছ সাগরের খুব কাছে পাওয়া যেত আজ সেগুলো শত শত মাইল দুরেও পাওয়া যায়না। যে চুনাপাথরের জন্য এই দ্বীপ বিখ্যাত সেই চুনাপাথর খোঁজে পাওয়া যায়না। সবুজ-শ্যামল গাছে গাছে সমারোহ পরিবেশ সংকটাপন্ন এই দ্বীপে আইন বহির্ভূতভাবে শত শত হোটেল – রিসোর্ট তৈরি করে মরুভূমির ন্যায় দ্বীপের ভারসাম্য যেমন হুমকির মুখে ফেলেছেন তেমনি চিহ্নিত দ্বীপদস্যুরা অবৈধভাবে দ্বীপের কুটি সমৃদ্ধ প্রবাল, শৈবাল, ঝিনুক, কড়ি ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ অন্যত্র পাচার করে দ্বীপের গঠনপ্রণালী ধ্বংস করছে। ফলে বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয় এই দ্বীপ। ৮ বর্গ কিঃমিঃ সেন্টমার্টিন আজ ৬ বর্গ কিঃমিঃ এবং ৩ মাইলের ছেড়া দিয়া ২ মাইলে রূপ নিয়েছে। এইতো গেল বছরের ঘূর্ণিঝড় কোমেনের তাণ্ডবের কথা এখনো চোখে ভাসে। “চারদিকে চিৎকার চেঁচামিচি। এক করুণ আর্তনাদ। প্রবল বর্ষণ ও প্রচণ্ড বাতাস বয়ে চলছে। পথে পথে গাছগাছালি ও বসতবাড়ির ছাউনি’র টিন পড়ে আছে। হঠাৎ অলিয়া পাড়ার ইসলামের বাড়িতে বিলাপের কণ্ঠ। বাবা! ও বাবা! তোমি আমাদের ছেড়ে যেওনা। ছোটছোট মাসুম-বাচ্চাদের আর্তনাদ! আয়েশা বেগম (ইসলামের স্ত্রী) চিৎকার করে করে বলছে, ওগো তোমি আমারে কোথায় রেখে চলে যাচ্ছ!? কি করে আমি এতগুলো সন্তানের ভরণপোষণ চালাব”! পরিবারের উপার্জনের একমাত্র কর্তাকে হারিয়ে আয়েশা বেগমের আহাজারিতে ঈশ্বরের অন্তর হয়তো খেপেছিল কিন্তু খেপেনি এই অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদের অন্তর। তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আয়েশা বেগমের কান্না উপভোগ করেছিল। নারকেল গাছের চাপা পড়ে মরা গিয়েছিল মানুষটি। আল্লাহ্‌ বেহেশত নসিব করুক। ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেলে ক্ষতি পূরণ পাই কিন্তু মরহুম ইসলামের পরিবার তাও পাইনি। স্থানীয় প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ্য থেকে কোন সাহায্য পাইনি আয়েশা বিবি। পাবেই-বা কি করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কি এসব খোঁজখবর রাখেন! মরা গিয়েছে আয়েশা বিবির স্বামী এতিম হয়েছে মরহুম ইসলামের সন্তানেরা তাতে জনপ্রতিনিধিদের কি আসে-যায়। তাদের (প্রতিনিধিদের) মনের অব্যক্ত কিছু কথা, “সবাই মরে যাক, ধ্বংস হয়ে যাক সবকিছু। সাগরের সাথে মিশে যাক এই দ্বীপ। বেড়িবাঁধ দিয়ে কি হবে! অনেক টাকা খরচ করে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছি টাকা তুলতে হবেনা!? পাঁচ বছর পর আবার ক্ষমতা পাবো তার কি বিশ্বাস, আপনি বাঁচলে বাপের নাম! দ্বীপ ধ্বংস হলে আমাদের কি হবে!? আমরাতো অন্যত্র জায়গাজমি নিয়েছি। ক্ষমতা পেয়ে ব্যাংক ব্যালেন্সও করেছি বেশ! বাজ”। ঈশ্বর প্রদত্ত এতগুলো সুযোগসুবিধা পাওয়ার পরও যে দ্বীপের মানুষ তার সঠিক মূল্যায়ন করতে জানেনা তাদের সাথেতো ঈশ্বর রাগ করতেই পারে। ক্ষমতাওলাদের অত্যাচার – অবিচার সইতে না পেরে মনে হয় প্রভু রাগে দুঃখে দ্বীপাঞ্চলের মানুষের উপর থেকে মুখ সরিয়েছে।

বাংলাদেশের একমাত্র ইউনিয়ন পরিষদ সেন্টমার্টিন যেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক সেন্টার নেই! কিন্তু ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল আছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে! শুনলে অবশ্যই ভাল লাগারই কথা। কিন্তু এই হাসপাতাল নামমাত্র শুধু। এখানে কাজের কাজ কিছুই নেই। নেই কোন ডাক্তার, নার্স। নেই কোন ওষুধ সামগ্রী। শুধু সরকারি প্যারাসিটামল ছাড়া বিশেষ কোন ওষুধ পাওয়া যায়না এই হাসপাতালে। প্রতিমাসে মাসে হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধের টাকা যায় কোথায়! কে বা কারা এই দ্বীপাঞ্চলের মানুষের চিকিৎসার টাকা মেরে দিচ্ছে তার কোন খোঁজখবর নেই মহামান্য জনপ্রতিনিধিদের। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতাল ও তার-সরঞ্জামাদি কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলায়, অযত্নে মরিচিকা-ধরার উপক্রম হয়ে পড়ে আছে। আজ যদি এই হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা থাকতো, ডাক্তার থাকতো তাহলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি ইহকাল ছেড়ে পরকালে ফাঁড়ি দিতেননা মরহুমা জয়নব, হামিদা, ছমিরা, ইয়াছমিনসহ অনেকে। জানি, ‘মৃত্যু প্রত্যেক মানুষের জন্য অবধারিত’। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু কেবা মেনে নিতে পারে। তারা প্রত্যেকে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় বা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ধাইমার ভুল সিদ্ধান্ত বা সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারা গেছিল। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু আজও খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে মৌঃ আব্দুর রহমানের পরিবারকে। চোখের জলে বিষণ্ণ পরিবেশে মরহুমা হামিদাকে বিদায় দিয়েছিলেন স্বামী মৌঃ আব্দুর রহমান ছেলে আব্বাস, করিম মেয়ে তাবাচ্ছুম ও জান্নাত।
জয়নবের ছোটছোট সাত নয় বছরের বাচ্চাগুলো কোনমতে বুঝতে চাইনা তাদের মা আর কোনদিন তাদের কাছে আসবেনা কথাটি। তাইতো ভোর সকালে সবার অজান্তে গুরুস্থানে মায়ের কবরের পাশে গিয়ে মা’কে ডেকে ডেকে বলে “মা, ওমা উঠো, আমাদের ছেড়ে কেন মাটির নিচে লুকিয়ে আছো! আমাদের জন্য মন কাঁদেনা তোমার!? আমাদের খেতে দাও! আমাদের খুব ক্ষিদে পেয়েছে মা! জানো মা, ছোট (রাহাত) তোমি চলে আসার পর থেকে কিছুই মুখে দেয়নি শুধু তোমার জন্যই কাঁদে”। মাছুম শিশুদের পবিত্র আহাজারি পিতা নুরুকে প্রতিনিয়ত আঘাত করলেও আঘাত করেনা প্রতিনিধি নামক সেই বিষাক্ত মনুষ্যত্বহীন মানুষগুলোকে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই শিক্ষক সংকট লেগেই আছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭০০ ছাত্রছাত্রীদের বিপরীতে মাত্র দু’জন শিক্ষক। ফলে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনায় চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। A+ শব্দটি এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্বপ্ন-মাত্র। কোনমতে প্রাথমিক পাস করে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। এদিকে একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়টিতে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগ ও ব্যবসায় বিভাগের কোন শিক্ষক নেই। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্যও A+ কেবল স্বপ্ন। বেশিভাগ ছাত্রছাত্রী ‘ডি গ্রেড’ নিয়ে পাস করে। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অতিরিক্ত শিক্ষক থাকলেও এই বিভাগেও কোন স্টুডেন্টস A- এর উপরে যায়না। শুধু হরতন – রুইতন খেলে সময় পার করছেন তাহারা (শিক্ষকরা)। যার – দরুন এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভাল কোন কলেজে ভর্তি হতে পারেনা ফলে ভাল কিছু অর্জন করতে কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে কোন উচ্চ-শিক্ষিত লোক নেই যার সুযোগে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিজের খেয়াল খুশিমতো চালায় এই বিদ্যালয়। জানা যায়, অন্য-বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ দিলে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের কিছু অতিরিক্ত শিক্ষক চাকরীচ্যুত হবে যাদের কাছ থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক মোটা অংকের হাদিয়া গ্রহণ করেছিল তাই তিনি ইচ্ছা করে অন্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেনা।

এই দ্বীপের মডেল ইউনিয়ন পরিষদ। অত্যাধুনিক ভবনে নির্মিত এই পরিষদ। বাংলাদেশের প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদে তথ্য-সেবা কেন্দ্র রয়েছে যেখান থেকে গ্রাম অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা পাই। যেমনঃ ফটোকপি, ইমেইল, কলেজ ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য, কৃষি তথ্য, মৎস্য তথ্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অনেককিছু। সেন্টমার্টিন দ্বীপের মডেল ইউনিয়ন পরিষদেও আছে এসবকিছু কিন্তু তা শুধু সাইনবোর্ডে সীমাবদ্ধ। গ্রাম আদালত, তথ্য-সেবা কেন্দ্র, মৎস্য ভবন, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অফিস-সহ আরও অনেককিছু সাইনবোর্ড মারফত দেখা যায় কিন্তু কখনওই এর সুফল পাইনি দ্বীপের মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম-গঞ্জের মিনি হাইকোর্ট হিসেবে পরিচিত। এই পরিষদে গ্রামের সমস্ত বিচার ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়। কিন্তু প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের ইউনিয়ন পরিষদ এর ব্যতিক্রম। এইখানে শুধু বাজেট বরাদ্দকরণ নিয়ে প্রতিনিধিদের মাঝে কথা কাটাকাটি, ধস্তাধস্তি ও ধাওয়া -পাল্টাধাওয়া ছাড়া তেমন কিছু দৃশ্যমান নেই। এই দ্বীপে সমস্ত বিচার হয় পুলিশ ফাঁড়ী বা কোস্টগার্ড স্টেশনে। হয়তো একসময় এই দ্বীপের মানুষ ভুলে যাবে ইউনিয়ন পরিষদ মানে কি! জনপ্রতিনিধিদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার সুযোগে পুলিশ – কোস্টগার্ড অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই দ্বীপাঞ্চলের মানুষের উপর।
পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এই দ্বীপাঞ্চলের মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে এই কেমন খেলা আপনাদের!? ভোটের সময় কেউ পায়ে ধরে কাঁদে, কেউ আত্নহত্যার হুমকি দেই, কেউ মোটা অংকের টাকা দেখায়। কোনদিকে যাবে এই এই দ্বীপের সাধারণ মানুষ! কেউ কেউ কান্নার কাছে হেরে যায়, কেউ কেউ আত্নহত্যাকে ভয় পাই আবার কেউ কেউ মোটা টাকার কাছে নত হয়ে নিজেদের অধিকার নিজেরাই খর্ব করে বসে। চিন্তা করেনি দিনের পর দিন নিজেদের অধিকার নিয়ে একশ্রেণীর শাসকগোষ্ঠী ছিনিমিনি খেলছে। ভাবতে পারেনি নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই তৈরি করে বসেছে কথাটি! হায়রে দ্বীপাঞ্চলের মানুষ! কান্না, আত্নহত্যার হুমকি ও টাকা দিয়ে কখনওই বিবেক বা মা’কে বিক্রি করা যায়না। ‘মা’ সমতুল্য এই দ্বীপকে কেমনে এত অবহেলা – অযত্নে ধ্বংস করে দিচ্ছ!? তোমাদের এই করুণ অবিচারে ঈশ্বরও রাগ করেছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তোমাদের উপর থেকে। সময় সুযোগ থাকতে নিজেকে শুধরে নিয়ে হয় – ‘প্রভু’র রাগ ভাঙ্গো! না’হয় ঘুমাও! এমনভাবে ঘুমাও যেন ঘুম থেকে উঠে দেখ তোমাদের বসতবাড়িও সাগরের সাথে মিশে গিয়েছে!!
বিঃদ্রঃ (এক বছর আগের সংকলন। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা ও চিকিৎসায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।)

হেলাল উদ্দিন সাগর
নিজস্ব প্রতিবেদক
দৈনিক কক্সবাজার ৭১

নির্বাহী সম্পাদক
সেন্টমার্টিন বিডি নিউজ-SBN.
01818-918746.

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...